আফসানা করিম আমার তিন বছর আগে চাকরীতে জয়েন করেছিল। তাকে চিনতাম না। কিন্তু সে আমাকে চিনতো। তখন সে চাকরী করত ইলাতলা উপজেলায় । আমি থাকতাম রাজধানী শহরে। তখনও বিয়ে-সাদী করিনি। তবে মা পাত্রী খুঁজছিলেন। আমাকে বার বার খবর দিচ্ছিলেন, যেভাবেই হোক ট্রান্সফার হয়ে ইলাতলায় চলে আসতে। এই বুড়ো বয়সে কেন এভাবে বাবা মাকে কষ্ট দিচ্ছি? এরকম নানা অভিযোগ । কিন্তু মাকে কি করে বোঝাই ? ওখানে আছেন মহিলা। তাকে সরিয়ে আমাকে ওখানে বদলী করবে না। অতএব বাস্তবতা মানতে হবে।
গরম পানির গলিতে একটা মেসে থাকতাম। আমার রুমমেট ওবায়েদ ভাই আমার চেয়ে সিনিয়র। আমাকে খুব ভালবাসতেন। বিষয়টা নিয়ে তার সাথে কথা বলতেই তিনি বললেন,
আরে, একথা আপনি আগে বলবেন তো । ইলাতলার আফসানা করিমকে সরানো খুব সহজ।
-কি বলেন ? একজন মহিলাকে সরাবে প্রশাসন ?
আপনি আফসানাকে চেনেন না। ওকে এদেশের যেখানে বদলী করা হবে ও হাসতে হাসতে সেখানে চলে যাবে।
-আপনিও রসিকতা করছেন, আমার সাথে ?
আমি কি কখনো তা করি ?
-না, তা করেন না, তবে এখন মনে হচ্ছে---- ।
মনে হবার কোন কারণ নেই। আপনার আবেদনটা নিয়ে আজই চলে যান। বাড়িতে যেয়ে মা বাবার সংগে দেখাটাও করে আসেন, আর মিউচুয়াল বদলীর জন্য ওর সম্মতিটাও লিখে নিয়ে আসেন। কাজ হয়ে যাবে।
-আপনার বাড়িতো অন্য থানায় । ও আমার এলাকার মেয়ে। আমি চিনি না, অথচ আপনি চিনলেন কিভাবে ?
এটা এখন বলব না। আগে ঘুরে আসেন, তার পরে বলব ।
কিছুতেই তিনি বললেন না।পেট ভরা কৌতূহল নিয়ে তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে গেলাম। মা বাবা খুব খুশী হলেন।বেশী খুশি হলেন মা। মনে হল যেন এবার আমাকে তিনি শিকলটা পরাতেই পারবেন।
ইলাতলা উপজেলা কমপ্লেক্স এর দ্বিতীয় তলায় আমাদের অফিস। আমাদের বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে । লোকাল বাস আর বেবি ট্যাক্সি হচ্ছে যাতায়াতের একমাত্র বাহন । অফিস টাইমে খুব ভিড় হয়। অনেক চাপাচাপি করে গেলাম অফিসে । কিন্তু হায় ! সেদিন সে অফিসে আসেনি।সেখান থেকে ওর বাসার ঠিকানাটা নিয়ে ওদের বাসায় গেলাম। দরজায় লেখা একটা নেমপ্লেট । মোঃ আব্দুল করিম, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, শিমুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। কলিং বেল চাপতেই ভেতর থেকে ভরাট কণ্ঠে বললেন,
কে ?
-আফসানা আপার অফিস কলিগ । উনি কি বাসায় আছেন ?
দরজা খুললেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে না বলে দরজায় দাঁড়িয়েই আমার দিকে চোখ বড় বড় করে
তাকিয়ে বললেন,
সে এখানে থাকে না। কি দরকার বলুন ? তাকে খবর দেয়া যাবে।
বিশাল দেহের এক মানুষ। দেখে মনে হয় ইউরোপীয় এলাকার মানুষ। তার দেহাবয়ব আর গলার আওয়াজ শুনে পিলে চমকে গেল।
-একটু অফিসিয়াল প্রয়োজন । উনার বাসার ঠিকানাটা দেয়া যাবে ?
না। (কথাটা বলে তিনি অন্য দিকে তাকালেন এবং বললেন) আপনার দরকারটা বলুন, তাকে জানিয়ে দেয়া যাবে। অথবা কাল ও অফিসে যাবে, তখন না হয় প্রয়োজনটা মিটিয়ে নেবেন ।
আর কিছু না বলে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদেয় নিলাম ।
পরদিন অফিসে ঢুকতেই আফসানাকে দেখে একটু ভড়কে গেলাম । ওরকম লাল টকটকে বাবার এরকম মিশমিশে কালো মেয়ে ! ঠিক যেমন সাদা মুরগীর বাচ্চাদের পালে কালো কুচকুচে বাচ্চা! আর চেহারাটার এমন যাদু ! কালো বলে ওকে নিন্দে করে, কার এমন সাধ্যি ? কালোর ভেতরেও যে এত রূপ থাকতে পারে, সে ওকে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। যুগে যুগে আফসানাদের মত এমন রূপসী কালো মেয়েরাই বুঝি কবিদের কাব্যে এত রস যুগিয়েছে। যে চেয়ারটায় সে বসে আছে সেটা দেখে মনে হচ্ছে সেই আফসানা, কিন্তু তার চেহারাটা বলছে সে করিম সাহেবের মেয়ে না।
দোটানায় পড়ে আমি তার টেবিলের কাছে গিয়ে বললাম, আপনি কি আফসানা আপা ?
-জ্বি, আপনি ?
(একটু অবাকই হলাম) আমি আদনান। ঢাকা থেকে এসেছি।
-ও, আপনিই তাহলে সে ?
মানে ? আপনি আমাকে চিনলেন কিভাবে ?
-চেহারায় চিনতাম না। নামে চিনি। বসুন ।
কথা বলার ফাঁকে সে আর একটা চায়ের অর্ডার দিল। তার মুখের হাসিটা যেন মহান স্রষ্টার আর এক মহাসৃষ্টি। স্থায়ীভাবে ঠোটে লেপটে দিয়েই যেন তাকে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছে । চায়ের কাপে চুমুক দেবার ভঙ্গীটাও অসাধারণ এক স্টাইল ! সত্যিই অবাক হবার মত। মিষ্টি কণ্ঠস্বর। খুব মৃদু স্বরে কথা বলেন ।
-আপনি কি আমার কাছে এসেছেন ?
হ্যাঁ ।
-কি দরকার , বলুন ?
বলছি। আপনি আমাকে চিনেন কিভাবে ?
-আপনার রুমমেট ওবায়েদ আপনার কথা বলেছে।
ও, আচ্ছা । তার সাথে আপনার পরিচয় ?
-ইউনিভার্সিটিতে আমরা এক ডিপার্টমেন্টে পড়তাম । তা, আমার কাছে কি দরকারে, বলুন তো ?
(দরখাস্তটা বের করে) কি করে যে বলি কথাটা, আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার বন্ধুই আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন এই দরখাস্তটা নিয়ে ।
এটি পড়ে তিনি একটু মুচকি হাসলেন। ওবায়েদ বলেছে ? তা, আপনি কি বলেন ? আমি একা একটা মেয়ে মানুষ রাজধানী শহরে যাব, আপনি পুরুষ মানুষ হয়ে মায়ের আচলের তলে আসবেন, এটা কি ঠিক ? আমার কথায় আপনি কিছু মনে করলে না তো ? কথাগুলো তিনি বলছেন ক্ষুব্ধ হয়েই। কিন্তু তার সে উপস্থাপন ভঙ্গিটা এমন বিচিত্র যে ,হাসি মাখা ঠোটে, মৃদু ভাষায় এভাবে মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে, সে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। হাসতে হাসতে একটা ধারালো ছুরি যেন আমার ঠিক বুকের মাঝখানে ঢুকিয়ে দু’ফালি করে দিল। লজ্জায় আমার মাথাটা হেট হয়ে গেল। চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এ রকম বোকামীর জন্য নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। কেন যে ওবায়েদ ভাইয়ের মশকরাটা বুঝতে পারলাম না, তা ভেবে নিজেকে খুব অপদার্থ মনে হতে লাগল ।
-কি ব্যাপার ? কিছু বলছেন না যে ? খুব কি বেশী কষ্ট দিলাম ?
খুব অস্বস্তিকর একটা মুহূর্ত আমার জীবনে । লজ্জায় তার দিকে তাকাতেই পারছিলাম না।
আমার বেগতিক অবস্থাটা বুঝতে পেরে তিনি মৃদু হাসছেন আর বলছেন,
-আরে, কি হল ? কিছু বলছেন না যে ?
নির্বোধের মত তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপা, সরি। আসলে আমি একটা গাধা । ওবায়েদ ভাই যে আমার সাথে মশকরা করছিলেন আমি তা না বুঝে আপনার কাছে এভাবে আমার বলাটা -- । সত্যিই আপা, আমি খুবই লজ্জিত । আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
- বাব্বা ! কি সাংঘাতিক ! সিরিয়াসলি রি-অ্যাক্ট করেছেন ! ফর্সা মানুষ , একেবারে মুখটা বেয়ে যেন রক্ত ঝরছে । আমার গায়ের রং কালোতো, তাই ফর্সা মানুষদের এভাবে দেখলে আমার খুব হিংসে হয় ।
আফসানা আপা আমার কথাগুলো যখন শুনছিলেন তখন আমার দিকে অপলক চেয়ে মিট মিট করে হাসছিলেন আর কথাগুলো বলছিলেন। আমি একটা অবোধ শিশুর মত দাঁড়িয়ে তার উপদেশ শুনছিলাম ।
তিনি হাসতে হাসতে আবার বললেন,
-আপনার ভেতর থেকে তো এখনো শৈশব কৈশোরের রেশই কাটেনি, তা এত অল্প বয়সে লেখা পড়া ছেড়ে চাকরীতে কেন ? আর ওবায়েদ আপনার সাথে মশকরা করে নি, ও ঠিকই বলেছে।
তার মানে ?
- আমি আসলে তথাকথিত মেয়েদের মত বন্দী জীবনে বিশ্বাসী না। তবে এখন একটু অন্য রকম সমস্যা না থাকলে আপনার আবেদনে আমার সম্মতিটা লিখে দিতাম । সত্যি, এজন্য আমি আপনাকে সরি বলছি। শুধু শুধু আপনার সময় নষ্ট হল।
তা,কেন ? আমিতো আসলে ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিলাম । যাক, আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভাল লাগল। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
কর্মস্থলে ফিরে ওবায়েদ ভাইকে বলতেই তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না। কিছুটা অবাকও হলেন। আর বলছেন,
তাহলে কি আফসানা চেইঞ্জ ?
-কি ব্যাপার বলেন না, ওবায়েদ ভাই। বলেছিলেন, ওর সম্পর্কে কিছু বলবেন । বলেন না ?
আচ্ছা, বলব । এত ব্যস্ত কেন ?
----------
এর পর কেটে গেল আরো কয়েকটা বছর । ঢাকা আমাকে মুক্তি দিল না। বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ করে আবার নতুন জীবনে বন্দী হয়ে গেলাম। পদোন্নতি পদে আজ প্রথম যোগদান । অফিসে যেয়েই হতবাক ।
আরে, আফসানা আপা, আপনি ?
-আপনিই তাহলে আমাদের বস হয়ে এলেন ?
আমি আপনাদের বস ? মানে ?
-আপনি চেয়েছিলেন, আমি ঢাকায় আসি। আল্লাহ কবুল করেছেন। তবে আপনার কোন উপকারে আসতে পারলাম না। আল্লাহর কী মহিমা দেখেন, সেদিন যদি আপনার ঐ উপকারটা করতাম তাহলে আজকে আপনার এই চেয়ারটার পরিবর্তন হতনা, কি বলেন ? তাহলে বলুন, উপকারটা না করে আপনার মঙ্গলই হয়েছে, তাই না ?
নিশ্চয়ই । আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী । তা, বদলী হলেন কবে ?
-অল্প কিছুদিন হল। পদোন্নতি পেয়ে ।
আমাদের একই ব্যাচে ?
-সে কপাল কি আর আমার আছে স্যার ? আপনিতো পরীক্ষায় পাশ দিয়ে টপকে চলে গেছেন। আমি জুনিয়র থেকে সিনিয়র হয়েছি ।
বাসা কোথায় ?
-আপাতত মহাখালীতে বোনের বাসায়। যাতায়াত খুব মুশকিল ।
কিছুদিন আমার সাথে আমাদের স্টাফ বাসে যেতে পারবেন, আমার গেস্ট হয়ে।
-গেস্ট কেন? একটা টিকেটের ব্যবস্থা করে দেন না ?
ননগেজেটেডদের টিকেট যে আমাদের গাড়িতে হবে না। আচ্ছা, অন্য কোন গাড়িতে দেয়া যাবে।
নতুন জয়েন করে আমার শাখার সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালাম। রুমটা ছোট । সবাই একটু কষ্ট করে বসেছেন। আমি এত কষ্ট করে বসতে পারব না স্যার। কিছু মনে করবেন না, আমি বরাবরই একটু অন্য রকম । বলেই আফসানা আপা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে একেবারে আমার চেয়ার ঘেঁষে বসলেন । আমার চেয়ারটায় হুইল ছিল । তাকে স্পেস দেয়ার জন্য একটু খানি পাশে ঠেলে নিলাম হুইলটা ।
সেদিনই গেস্ট হিসেবে আমাদের গাড়িতে আপাকে নিলাম। সামনের সিটগুলোতে মহিলারা বসে আছেন, একটাতে বসতে বললাম। কিন্তু তিনি কোন কথা না বলে আমার সাথে পেছনে এলেন এবং আস্তে করে বললেন,
-এখানে বসলে আপনার আপত্তি আছে ?
আমি হেসে বললাম, না , না, আপত্তি কিসের ?
-অফিসে আপনার পাশে বসাতে যেভাবে ঝটিকার গতিতে ছিটকে সরে গিয়েছিলেন, সে কারণেই ভাবলাম, আপনার যদি--- ।
ছি ! ছি! এ কি বলছেন ? তা নয়, আসলে এখানে আমরা কয়েকজন মিলে বেশ অন্য রকমের আড্ডা জমিয়ে ফেলি। রাস্তায় যে যান জট ! সময় কাটে না, তাই নানা রকম বেফাঁস আড্ডাবাজী চলে । আপনি বসলে আমরা সেই আড্ডাটুকু থেকে বঞ্চিত হব।
-তা, আমি কেন সে আড্ডায় শরীক হতে পারব না ?
তা , পারবেন, তবে আমরা হয়তো সেভাবে জমিয়ে আড্ডাটা জমাতে পারব না।
-আমি আছি আপনাদের সাথে। নো হেজিটেশন । আর আমি আমার জীবনে বাসে চড়ে কোনদিন কোন মহিলার পাশে বসিনি। সীট খালি থাকলেও না।
কেন ?
-কেন আবার ? এই যে আপনারা পুরুষরা আমাদেরকে মেয়ে মানুষ হিসেবে একটু আলাদা করে ভাবেন, তাই ।
আপনি কি আলাদা নন ?
-আপনারা আলাদা ভাবেন, তাই । এক মায়ের পেটে জন্মেছি। একই রক্ত খেয়েছি, একই দুধ পান করেছি। তাহলে ভাই আর আমি আলাদা কি করে হলাম ?
আপা, প্লীজ ! এটা অনেক গুরু গম্ভীর লম্বা বিষয় । এ নিয়ে না হয় আর একদিন কথা হবে । তার চেয়ে চলুন, অন্য প্রসঙ্গে। ভাই, বাচ্চারা ?
-এটা নিয়েও এখন নয় । পরে আলাপ হবে । আপনার বাসা ?
উত্তরায় ।
-বাব্বা,সে তো অনেক দূর ।
হ্যা, সর্বনিম্ন দেড় ঘণ্টা । ভাগ্য যেদিন আরও বেশী ভাল হয় সেদিন সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪ ঘণ্টাও লাগে ।
- ভাবী কি করেন ?
ঘরের চাকরী ।
-বাচ্চা ?
এক ছেলে ক্লাস সিক্স । আর একজন টু তে ।
-কতটা বছর হয়ে গেল, না ? সেই যে, যখন মায়ের কাছে যাবেন বলে বদলী হতে চেয়েছিলেন, তখনতো বিয়ে করেন নি, তাই না ?
তার পরের বছরই বিয়ে করেছিলাম। তবে মায়ের আশা আজও পূরণ করতে পারলাম না।
-আপনি বাবা মাকে খুব ভালবাসেন, তাই না ?
এটা আবার কেমন কথা ? বাবা মাকে ভাল না বাসে কোন সন্তান ?
-আপনি দেখছি কিছুই জানেন না, কেন, কুসন্তান ।
তাই আবার হয় না কি ?
- আপনি সোজা মানুষতো, তাই সব সোজা দেখেন। বাঁকা মানুষ দেখেন নাই , তাই ধারনা নাই ।
হয়তো বা ।
গল্পে সল্পে মহাখালী চলে এলাম। আপা একখানা হাসি মাখা ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে গেলেন ।
এরপরে কেটে গেল বেশ কিছু দিন। আপার জীবনের অনেক দুর্বিসহ ঘটনার কথা শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল । এরকম সুন্দর মনের একজন মানুষ এভাবে কেন বিতাড়িত হলেন ? আসলে আপার জীবনের বিড়ম্বনা তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন। তার একটা সাদা মন আছে, এটা ঠিক। মানব জীবন কিভাবে, কেমন করে সুন্দর ভাবে চলতে পারে তার বিশদ ব্যাখ্যা রয়েছে আল্লাহর দেয়া সংবিধানে। কিন্তু মানুষ তাদের নিজেদের স্বার্থে নিজেদের ইচ্ছেমত স্বাধীন জীবন যাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাতে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য আছে বটে, তবে এরূপ জীবন-ব্যবস্থায় অনেক সময় অনেক যুক্তি থমকে যায় বাস্তবতার আলোকে । তখন তারা ধর্মকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। কিন্তু উপযুক্ত সমাধান খুঁজে পায় না। কেননা কিছু মানি আর কিছু মানি না, এভাবে জীবনের কোন সমাধান হতে পারে না। আপার প্রথম স্বামী তার ভাষায় চরিত্রহীন একটা লোক ছিল। তার কথিত অনাচারের অত্যাচারে বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে তিনি তাকে তালাক দিয়ে বাবার কাছে চলে আসেন। বিয়ে আর করবেন না বলেই স্থির করেছিলেন। কিন্তু তার বাবা তাতে নারাজ। অল্প বয়স। কালো হলেও তার চেহারার বিশেষত্বের কারণে তাকে অনেকেই পছন্দ করে। অনিচ্ছা স্বত্তেও তার জীবনের সব ঘটনা জেনেই আর একজন এলেন তার জীবনে । কিন্তু সেখানেও তিনি টিকতে পারলেন না। ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব, আমিত্বের বড়াই আর ধর্মীয় বিধি বিধানের প্রতি অবজ্ঞাই তাদের সংসার ভাঙার অন্যতম কারণ, সেটা আপার কথাতেই বোঝাগেল। কিন্তু এ অমোঘ সত্যটা এর স্বামীরাও যেমন বোঝেননাই, তেমনি আফসানা এত লেখাপড়া করেও তা বুঝতে চাইল না। সাধ্য মত বোঝাবার চেষ্টা করলাম। আপা সেদিন খুব কাঁদলেন, বললেন, মেয়েটাকে তার বাবা নিয়ে গেছে। এমন মন্ত্র ঢুকিয়েছে তার মাথায় যে তার বাবা তার কাছে পয়গম্বর । আমাকে সে সহ্যই করতে পারে না। অথচ কত দুর্বিসহ জীবন নিয়ে ওকে আমি খাইয়ে পরিয়ে বড় করেছি । এত বড় অকৃতজ্ঞ ! একবার সে কথা চিন্তাও করে না। আমার মুখটাও না কি সে আর দেখবে না।
আপাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, সময় সব ঠিক করে দেবে।
তার মনটাকে একটু অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললাম, আপা, একটা বিষয় আমার জানার খুব কৌতূহল । বাসে চলতে যেয়ে আমি অনেক দেখেছি ,মেয়েরা মেয়েদের পাশে বসতে চায় না, আপনিও বললেন সেদিন। এর কারণ কি ?
একটু হাসলেন ।
-অন্যদের কি কারণ তাতো আমি বলতে পারব না। তবে আমি বসি না আসলে যার পাশে বসব, তার গায়ের গন্ধটাই আমার সহ্য হয় না।
আমি বললাম, তাহলে যে পুরুষের পাশে বসেন, তার গায়ের গন্ধ লাগে না ?
-আবারো মুচকি হেসে বললেন, পুরুষের গায়ের গন্ধ আমার খারাপ লাগে না ।
আপার কথা শুনে একটু হাসলাম। আমি সেদিন তাকে কয়েকটা বই দিলাম । বললাম, এগুলো একটু মন দিয়ে পড়বেন। আশা করি আপনার ভাল লাগবে ।
অনেকদিন পর বুয়েটের সাবেক প্রফেসর ম হামিদের বাসায় গেলাম। কর্ম ব্যস্ততার কারণে প্রায়ই উনার মাহফিলে যেতে পারি না। একটু সময় পেলেই যাই। মানুষ হিসেবে আমাদের কি করা উচিত এ বিষয়ে কিছু নসিহত হয়, শুনতে ভাল লাগে। দিলটা নরম হয় । রিক্সা থেকে নেমে ভাড়াটা দিচ্ছি। এমন সময় আগাগোড়া বোরকায় মোড়া একজন ভদ্র মহিলা বললেন, আসসালামু আলাইকুম স্যার, আমি আফসানা। কণ্ঠটাই তার পরিচয়। নাম না বললেও চিনতে কষ্ট হত না।
অবাক হয়ে বললাম, এ ঠিকানাটা পেলেন কোথায় ?
-আপনি যে বইগুলো দিয়েছিলেন, তার মধ্যে এই স্যারের লেখা একটা বই ছিল। তাতে ঠিকানাটা খুঁজে পেলাম । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।